২০১৫ তে
জীবনের প্রথম ট্রেক সান্দাকফু করার সময় কখনো ভাবিনি যে কোনোদিনও গোচালা করতে পারবো।
কিন্তু ইচ্ছে ছিল ভরপুর। তাই অক্টোবর ২০১৮, দূর্গা পুজো শেষ হতে না হতেই দশমীর দিনই
বেরিয়ে পড়লাম গোচালার উদ্দেশ্যে। রাতের দার্জিলিং মেইল ধরে আমরা তিন বন্ধু পরেরদিন
সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি। আমাদের বাকি তিন বন্ধু আগের দিনই পুনে ও দিল্লি
থেকে বিমানে করে পৌঁছে গেছিলো বাগডোগরা, ও সেখান থেকে নিউ জলপাইগুড়ি। আমাদের জন্য ইওকসাম
যাবার গাড়ি আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল স্টেশনের কাছেই। স্টেশনের সামনেই প্রাতরাশ সেরে,
গাড়ির মাথায় আমাদের জিনিসপত্র বেঁধে চল্লাম ইওকসামের পথে। রাস্তা তৈরির কাজ হবার জন্য
আমাদের অনেক ঘুরপথে যেতে হয়েছিল। ইওকসাম পৌঁছতে পৌঁছিতে সন্ধ্যে হয়ে গেছিলো, তখন ওখানে
বৃষ্টি হচ্ছিলো। ছোট জনপদ এই ইওকসাম। ট্ৰেকিং দৌলতে হোটেল, জিনিসপত্রের দোকান, রেস্টুরেন্ট
সবই আছে। আমরা আজ থাকবো কাঞ্চনজঙ্ঘা লজে। আগামীকালের পরিকল্পনা নিয়ে নিজেরা আলোচনা
করতে করতে, আমাদের ট্রেক লিড তাশি ভাই এবং গাইড মামাজি আমাদের সাথে দেখা করতে চলে এসেছিলো।
তাশি ভাই বল্লো আমরা পরের দিন সকাল ৮টা নাগাদ বেরোবো। আমাদের মালপত্র বয়ে নিয়ে যাবার
জন্য দুজন ঘোড়াওয়ালা আমাদের সাথে যাবেন। আর আমাদের কুক হলেন চন্দ্রহান, ওনার নাকি ৪৫
বারের মতন এই ট্রেকটি হয়ে গেছে। যেকোনো থেকে খাবারটাও খুব জরুরি| কারণ এতো পথ হাঁটার
জন্য সব সময় ভালো খাওয়া দাওয়া যেমন খুব জরুরি, তেমনই খাবার খুব হালকা হওয়া দরকার| তাই
একজন অভিজ্ঞ কুক পেয়ে আমাদের বেশ সুবিধেই হলো| ক্লান্ত শরীরকে আর কষ্ট না দিয়ে, আজ
হোটেলেই রাতের খাবার সেরে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়লাম।
পরেরদিন
সবকিছু গুছিয়ে ৮টা নাগাদ হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। তাশি ভাই, মামাজি পুরো টিম নিয়ে
চলে এসেছেন ততক্ষনে। প্রাতরাশ সেরে রুকস্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের প্রথম দিনের
ট্রেকে। সত্যি বলতে প্রথম দিনের স্মৃতি বলতে যা মনে পরে, স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়াএ জঙ্গলের
মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চলছিলাম। যেকোনো ট্রেকের প্রথম দিনটা খুব কষ্ট হয়, শুধু মনের
জোরে হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে চলতে থাকি। তাশি ভাই এবং মামাজির সাথে হরেক রকম গল্প করতে
করতে চলতে থাকলাম। আজকের সারাদিনের পথটাই আস্তে
আস্তে চড়াই হলেও, ব্রিজ পার করার সময়ে প্রথমে খুব উৎরাই, তারপর বেশ খাড়াই। মোটামুটি
দুপুর ৩টে নাগাদ আমরা সাচেন গিয়ে পৌঁছলাম। কিভাবে যে হাসি ঠাট্টা করতে করতে সময় ট্রেকের
প্রথম দিনটা কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। সাচেনে পৌঁছেই আমাদের জন্য তৈরী ছিল গরম গরম
স্যুপ। স্যাতস্যাতে আবহাওয়ায় জঙ্গলের ভিতরে এটকি ছোট্ট ছাউনি। সেখানে সবাই গোল করে
বসে আড্ডা শুরু করলাম। গল্প করতে করতে জঙ্গলের মাঝে পাহাড়ে ঝুপ করে নেমে আসলো অন্ধকার।
আজ ট্রেকের
দ্বিতীয় দিন। প্রাতরাশ সেরে ২লিটার জল ভোরে নিলাম রুকস্যাকে। আজও আবহাওয়া মেঘলা, স্যাতস্যাতে।
সাচেন থেকে সোখার রাস্তা পুরোটাই চড়াই। হাঁটার সময় রীতিমত গরম লাগে, কিন্তু দাঁড়ানো
যায় না। দাঁড়ালেই ঠান্ডা লাগে। প্রায় তিন ঘন্টা চলার পর পৌঁছে গেলাম ৰাখিম। এখানে একটি
ছোট্ট দোকান আছে, ওখানে আমরা পেয়ে গেলাম গরম গরম কফি। আজ আমাদের গন্তব্যস্থল সোখা এখন
থেকে খুব বেশি হলে ১।৫ঘণ্টা। তাই ৰাখিমে একটু জিরিয়ে নিলাম। এখন থেকে যদিও অল্প অল্প
নীল আকাশ দেখা গেলেও আকাশের মুখ তখনও গোমড়া, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ৩টের মধ্যেই পৌঁছে
গেলাম সোখা। আজও চন্দ্রহান আমাদের জন্য এক গ্লাস সুস্বাদু পানীয় বানিয়ে রেখেছিলেন।
আমরা যেখানে আস্তে আস্তে হাফিয়ে যাচ্ছি, সেখানে চন্দ্রহান আগে এসে আমাদের জন্য পানীয়
বানিয়েও ফেললো। এবার বুজলাম প্রায় ৪৫বার গোএচালা করার অভিজ্ঞতা কাকে বলে। একটু জিরিয়ে
বেরিয়ে পড়লাম অলস ভ্রমণে। একটু দূরে একটি হ্রদের পাশে কিছুক্ষন জিরিয়ে ক্যাম্পসাইট
ফিরে আসলাম। ট্রেক লিড তাশি বললো এখন থেকেই মাউন্ট পান্ডিম, তেনচেনখাং দেখা যায়। কিন্তু
আকাশ মেঘলা বলে, আজ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমাদের ছেড়ে আসা ইওকসামের আলোগুলো
দূরে পাহাড়ে কোলে জ্বলজ্বল করছিলো, সাথে দেখা যাচ্ছিল দার্জিলিং ও পেলিং।
আজ ট্রেকের
দ্বিতীয় দিন। প্রাতরাশ সেরে ২লিটার জল বোতলবন্দি করে গুছিয়ে নিলাম রুকস্যাক। আজও আবহাওয়া
মেঘলা ও স্যাতস্যাতে। সাচেন থেকে সোখার রাস্তা পুরোটাই চড়াই। হাঁটার সময় রীতিমত গরম
লাগে, কিন্তু দাঁড়ানো যায় না। দাঁড়ালেই ঠান্ডা লাগে। প্রায় তিন ঘন্টা চলার পর পৌঁছে
গেলাম ৰাখিম। এখানে একটি ছোট্ট দোকান আছে, ওখানে আমরা পেয়ে গেলাম গরম গরম কফি। আমাদের
গন্তব্যস্থল সোখা এখন থেকে খুব বেশি হলে ১.৫ঘণ্টা। তাই ৰাখিমে একটু জিরিয়ে নিলাম। এখন
থেকে অল্প অল্প নীল আকাশ দেখা গেলেও আকাশের মুখ তখনও গোমড়া। বৃষ্টি নামার ভয়ে, তাড়াতাড়ি
পা চালিয়ে ৩টের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সোখা। আজও চন্দ্রহান আমাদের জন্য এক গ্লাস সুস্বাদু
পানীয় বানিয়ে রেখেছিলেন। আমরা যেখানে চলতে চলতে হাফিয়ে যাচ্ছি, সেখানে চন্দ্রহান আগে
এসে আমাদের জন্য পানীয় বানিয়েও ফেললো। এবার বুজলাম প্রায় ৪৫বার গোএচালা করার অভিজ্ঞতা
কাকে বলে। একটু জিরিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অলস ভ্রমণে। একটু দূরে একটি হ্রদের পাশে বেশ কিছুক্ষন
সময় জিরিয়ে ক্যাম্পসাইট ফিরে আসলাম। ট্রেক লিড তাশি বললো এখান থেকেই মাউন্ট পান্ডিম,
তেনচেনখাং দেখা যায়। কিন্তু আকাশ মেঘলা বলে, আজ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমাদের
ছেড়ে আসা ইওকসামের আলোগুলো দূরে পাহাড়ে কোলে জ্বলজ্বল করছিলো, সাথে দেখা যাচ্ছিল দার্জিলিং
ও পেলিং। রাতের খাবার তৈরী। রুটি, সবজি আর ঘন ডালের সাথে হালুয়া আজকের রাতের মেনু।
ঘড়ির কাটায় মোটে ৭:৩০, কিন্তু কালকের দিনটি নাকি ট্রেকের সবচেয়ে কঠিন তাই আজ দেরি না
করে তারাতারি ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকাল সকাল
হালকা শোরগোলে ঘুম ভাঙলো। টেন্টের জিপ খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখি সবাই জটলা হয়ে টেন্টের
উল্টো দিকে তাকিয়ে। কনকনে ঠাণ্ডায় হাড় হীম করে দেবার জোগাড়। কিন্তু টেন্ট থেকে বেরোনোর
পর যা দৃশ্য দেখলাম তাতে মন ভরে গেলো, ততক্ষনে সূর্যের রক্তাভ আভায় নিজের রং পাল্টেছে
মাউন্ট পান্ডিম, রং যেন গলে গলে পড়ছে। দেখে মনে হচ্ছিল যেন দূরে এক সোনার খনি। ক্যামেরাবন্দি
করে নিলাম প্রকৃতির সেই অপরূপ দৃশ্য। বেশি সময় নষ্ট না করে, সকালের প্রাতরাশ সেরে রুকস্যাক
গুছিয়ে নিলাম। বাক্স করে আমরা রুটি সবজিও নিয়ে নিলাম আজকের লাঞ্চের জন্য। আজ আমাদের
গনব্যস্থল জংরি। আমার এক বন্ধু ৩বছর আগে গোএচালা ট্রেক করতে গিয়ে এই পথ থেকে ইওকসাম
ফিরে গেছিলো। সোখা থেকে ফেডঙ এর রাস্তা পুরোপুরিই খাড়াই। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ভীষণ সুন্দর
কাঠের রাস্তা। সূর্যের আলো রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছায় না বললেই চলে। আজ ফ্লিজ জ্যাকেট টাও
পরে নিতে হয়েছে ঠান্ডার জন্য। কিন্তু একবার চলা শুরু করাতেই ঘাম হতে শুরু করে দিলো,
আবার দাঁড়ালেই কনকনে ঠান্ডা লাগছিলো। তাই ঠিক করলাম যত কষ্টই হোক দাঁড়ালে চলবে না,
তাই আস্তে চলতে থাকলাম। কলকাতায় শীতকালে মুখে দিয়ে ধোয়া বেরোতে দেখেছি। কিন্তু হাটতে
হাটতে লক্ষ করলাম, আমাদের গা থেকেই ধোয়া বেরোচ্ছিলও। মালবাহি চমরীগাই আর ঘোড়ার জন্য
মাঝে মধ্যেই আমাদের দাঁড়িয়ে যেতে হচ্ছিলো। ২ ঘণ্টা চলার পর হাঁফাতে হাঁফাতে আমরা বড়
পাথরের নিচে গিয়ে পৌঁছলাম। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে চল্লাম ফেডং এর দিকে। এখনের
রাস্তা যেন আরও চড়াই। আস্তে আস্তে চলতে চলতে
প্রায় ১টা নাগাদ গিয়ে ফেডং পৌঁছলাম। চারিদিকে মেঘ না কুয়াশা, ঠিক বোঝা গেল না,
কিন্তু তা এতো ঘন ছিল যে ১০০মিটার দূরেরও কিছু দেখা যাচ্ছিলো না। মামাজি আমাদের জন্য
ফ্লাস্কে করে গরম চা নিয়ে এসেছে। আমি সত্যি বলতে জীবনে এতো তৃপ্তি করে কোনোদিন চা খাইনি।
খিদেতে পেট ও চুইচুই করছিলো, তাই বাস্ক খুলে লাঞ্চটাও সেরে নিলাম। তাশি ভাই জানালো,
আমরা একটু ধীরেই চলছি ঠিকই, কিন্তু তাও ঠিকঠাক সময়ই জংরি পৌঁছে যাবো। কিছুক্ষন বিশ্রাম
নিয়ে আবার তৈরী হয়ে নিলাম। আরও ১.৫ ঘণ্টা চলার পর আমরা পৌঁছে গেলাম দেওরালী টপ। আমি
আর মামাজি সবার আগে পৌঁছে দেখি দেওরালী টপে হালকা হালকা বরফ পড়াও শুরু হয়ে গেছে। বেশি
জোর শুরু হবার আগেই পঞ্চোটা পরে নিলাম। সবাই দেওরালী টপ পৌঁছানো পর্যন্ত মামাজীর সাথে
একটু জমিয়ে আড্ডাও মেরে নিলাম। ট্রেকের প্রথম তুষারপাত দেখে সবাই বেশ মজাই পাচ্ছিলাম,
কিন্তু ভয় হচ্ছিলো যদি বেশি জোরে শুরু হয়ে যাই। তাই বেশি সময়ে নষ্ট না করে আস্তে আস্তে
এগিয়ে চল্লাম। প্রায় ৩:৩০ নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম জংরি। পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে যাওয়ায়
টেন্ট বানানোর জায়গা অন্য টিম নিয়ে নিয়েছে। তাই আজ আমরা একটি ট্রেকার্স হাটে রাত কাটাব।
চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট একটি জায়গা জংরি।
চারিদিকে বরফের একটা পাতলা আস্তরণ হয়ে আছে। তাসি ভাই বলে গেল বেশি করে জল খেতে,
কারণ আজ আমরা প্রায় ১২,০০০ফুট এ আছি। জল কম খেলে AMS(Acute Mountain Sickness) এর ভয়
থেকে যায়। আমরা ট্রেকার্স হাটে রুকস্যাকটা রেখে গরম গরম কফি খেলাম, তারপর সামনের পাহাড়ের
উপরে বসে সূর্যাস্ত উপভোগ করলাম। সামনে দেখা যাচ্ছিল ফ্রগ পিক। সূর্য ডোবার সাথে সাথে
ভীষণ ঠান্ডা পরে যায় বলে সবাই মিলে ট্রেকার্স হাটে ফিরে আসলাম। আজ আমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে
শুয়ে পড়বো কারণ ভোর ৩টে উঠে আমাদের জংরি টপ যেতে হবে। জংরি টপ থেকে দেখা সূর্যোদয় নাকি
অপরূপ সুন্দর, সেটা মিস করা যাবে না। মামাজি ৬:৩০ নাগাদ আমাদের ডিনার পরিবেশন করে দিলেন।
তাড়াতাড়ি খেয়ে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়লাম।
৩টের এলার্ম
ঘুম ভেঙে যখন বাইরে বেরোলাম, সে এক ভয়ঙ্কর সুন্দর দৃশ্য। আকাশে কোটি কোটি তারা জ্বলজ্বল
করছে, তার আলোয় কোনোরকম হেডটর্চ বা আলো ছাড়াই চারিদিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মামাজি আমাদের
জন্য গরম জলের ব্যবসা করে দিলো। রেডি হয়ে ৪টের মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম আমরা। আজ রাস্তাটা
ভীষণ চড়াই ও ভোরবেলা বাতাসে অক্সিজেন কম বলে ভীষণ কষ্ট হয় উঠতে। কিন্তু সানরাইসও মিস
করা যাবেনা। তাই মনের জোরে এগোতে থাকলাম। একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, একটা লম্বা
সুওপোকা যেন জ্বলজ্বল করছে। সেটি আসলে অন্যান্য লোকেদের হেডটর্চ, তারা লাইন ধরে আস্তে
আস্তে এগিয়ে আসছে। ৫:১৫ নাগাদ পৌছে গেলাম জংরি টপ। তাপমাত্রা -৫℃ হবে, তখনও সূর্য ওঠেনী আবছা আলোয়
দেখা যাচ্ছে তেনচেনখাং, পান্ডিম, কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাব্রু, ফ্রেপিক (ডানদিক থেকে বাম দিক)।
ধীরে ধীরে সূর্যের প্রথম আলো কাঞ্চনজঙ্ঘায় পরে সোনালি হয়ে উঠলো, রং যেন গলে গলে পড়ছে।
এতো কাছে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা কখনো দেখিনি, আজ প্রকৃতিও যেন আমাদের সাথে। তাসি ভাই আমাদের
জন্য গরম গরম ব্ল্যাক কফি নিয়ে এসেছে ফ্লাস্কে করে। সত্যি বলতে ১৪,০০০ ফুটে এই পরিষেবা
যেকোনো ফাইভ-স্টার হোটেলের থেকে শতগুন ভাল। সত্যি বলতে গরম গরম কফি খাওয়াতে আমরা প্রায়
২ঘন্টা ওখানে কাটাতে পেরেছিলাম। একপ্রস্থ ফটোশুটও সেরে নিলাম আমরা বন্ধুরা। ব্রেকফাস্টের
টাইম হয়ে গেছে বলে তাসি ভাই নীচে নেমে গেছে, কিন্তু মামাজি আমাদের সাথেই ছিল। প্রায়
৭:৩০টা নাগাদ গোএচালার হরেক রকম গল্প শুনতে শুনতে আমরা নীচে নেমে আসলাম। কিন্ত নীচে
এখনও সূর্যের আলো পৌঁছায়নি। কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে আসলো গরম গরম আলুপরোটা। এতো ভালো
আলুপরোটা আমি সত্যিই কখনো খাইনি। এত সুন্দর ব্রেকফাস্টের জন্য আমরা কিচেনে গিয়ে চন্দ্রহানকে
ধন্যবাদ জানিয়ে আসলাম। আজ সারাদিন আর তেমন কিছু করার নেই, তাই সবাই হাটে ঢুকে একপ্রস্থ
তাস পিটিয়ে নিলাম। বেলা বাড়তে বাড়তে নীল আকাশও ঢেকে গেল ঘন মেঘে। দুপুর পড়তে পড়তে ঠান্ডাও
বেড়ে গেছিলো, তাই আজ আর কোথাও না গিয়ে বিশ্রাম করেই কাটালাম। চন্দ্রহান বিকেলের স্ন্যাকস-এ
আবার সামোসা(সিঙ্গারা) বানিয়েছে। ট্রেকে এসে লোকের ওজন কমে, আমার তো মনে হচ্ছে আমি
২কিলো বাড়িয়ে কলকাতা ফিরবো। অন্যান্ন ট্রেকার বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে মারতে আজকের
দিনটা শেষ হলো।
আগের দিনের
মতন আজকেও নীল ঝকঝকে আকাশ, মেঘের নামমাত্র নেই। অন্যান্ন ট্রেকারদের টেন্টে একটা অদ্ভুত
জিনিস দেখলাম, টেন্টের থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বুঝলাম টেন্টের উপর সারারাতের জমা বরফ
রোদ পরে বাষ্প হয়ে যাচ্ছে। এটা দেখে রাতের তাপমাত্রা সম্পর্কে একটা অনুমান হয়ে গেল।
ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আজকের গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে, থানসিং। আজকের ট্রেকরুটের
ভিউ অনেকটা ওয়াইড। প্রথমেই কিছুটা চড়াই কিন্তু তারপর থেকেই মোটামুটি সমান রাস্তা। সামনেই
দাঁড়িয়ে আছে তেনচেনখাং। কিছুটা হাটার পর উকি দিলো পান্ডিম। আজকের রাস্তা ভীষণ মনোরম,
ছোট বড় বিভিন্ন রকম ফুলের গাছের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। হাটুসমান ঝোপ রাস্তার দুদিকে, হরেক
রকম রং লাল, হলুদ, সবুজ। মাঝে দুটো অল্প জমে থাকা নদীও পার করে নিলাম। সূর্যের আলো
পিঠে পড়াতে তেমন ঠান্ডা আর লাগছে না। সামনে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে উকি মারছে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
আমরা মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্য অনুভব করেছি। দূরে দেখা যাচ্ছে থানসিং
ও নীচে প্রেকচু নদী। রাস্তাটা হঠাৎই নীচে নেমে গেছে। প্রায় ৪৫ মিনিট নীচে নামার পর
যেখানে পৌঁছলাম, তা দেখে সবারই চোখ ছানাবড়া। এতো সুন্দর জায়গা যে আমাদের দেশে আছে জানাই
ছিল না। একটি ছোট্ট ট্রেকারস হাট, তারপর দুটো ছোট ছোট সচ্ছ ও শান্ত জলধারা, উপর দিয়ে
কাঠের ব্রীজ। তারপর প্রেকচু নদী বয়ে চলেছে গর্জন করতে করতে। চারিদিকে লাল, কমলা, সবুজ
রঙের শত প্রকারের গাছ। সামনে দেখা যাচ্ছে মাউন্ট পান্ডিম। একটা বড় পাথরের উপর বসে বক্স
লাঞ্চটাও সেরে নিলাম। সত্যি বলতে জায়গাটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছেই করছিল না, কিন্তু আজ আমাদের
থানসিং পৌঁছতে হবে তাই এগিয়ে চললাম। প্রেকচু নদীর পাস দিয়ে চলতে চলতে প্রায় ১.৫ঘণ্টার
মধ্যেই পৌঁছে গেল থানসিং। এক সুপ্রসস্থ উপত্যকা হল থানসিং, একদিকে দাঁড়িয়ে পান্ডিম
অন্যদিকে বয়ে চলেছে প্রেকচু নদী। উপত্যকায় চড়ে বেড়াচ্ছে অনেক ঘোড়া ও চমড়িগাই। সামনেই
দুটো ট্রেকারস হাট থাকলেও আমাদের জন্য টেন্ট বানানো হয়ে গেছে। এই ট্রেকের সবচেয়ে সুন্দর
ক্যাম্পসাইট এটাই। কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হয় গেল তুষারপাত। আজ আমাদের ডিনার ট্রেকার
হাটেই হবে। তাই সবাই হেডল্যাম্প নিয়ে পৌছে গেলাম। সন্ধ্যে হতে হতে তুষারপাতও কমে গেল।
ডিনার সেরে বন্ধুরা ঠিক করলাম আজ একটু নাইট ফটোগ্রাফি হোক। তাপমাত্রা -৬℃ থেকে -৮℃ হলেও চাঁদের আলোয় আমরা খুব মজা করেছি।
পরের দিনের ট্রেক মাত্র ২ঘন্টার তাই তাড়াতাড়ি শোবারও তারা নেই। চাঁদের রুপালি আলোয়
বরফাবৃত থানসিং উপত্যকা সত্যিই মায়াবী। ফটোসেশন শেষ করে টেন্টে স্লিপিংব্যাগে ঢুকে
পড়লেও ঠান্ডায় কাঁপতে থাকলাম অনেক্ষন।
পরেরদিন
সকালে উঠে দেখি টেন্টের ভিতরে একটা ছোট্ট বরফের আস্তরণ হয়ে আছে। বুজলাম আমাদের নিঃশ্বাসের
সাথে যে গরম হওয়া বেরিয়েছে সেগুলোই টেন্টের ভিতরের দেওয়ালে একটা বরফের আস্তরণ করে দিয়েছে।
মামাজি সকাল সকাল লাল চা ও বিস্কুট নিয়ে হাজির। ওনাদের এই অদ্ভুত আয়োজন এই কঠিন ট্রেকটিকে
অপেক্ষাকৃত সোজা করে দিয়েছে। আমরা সবাই প্রেকচু নদীর দিকে এগিয়ে গেলাম, কারণ সূর্যের
আলো উপত্যকায় প্রথম ঐদিক থেকেই পরে। কিছুক্ষণ রোদ পুহিয়ে আমরা টেন্টের দিকে এগিয়ে আসলাম।
রোজকের মতন আজও ব্রেকফাস্টে সারপ্রাইস, প্যান-কেক। চন্দ্রহানকে মনে হয় থ্যাংকস বলতে
বলতে হাঁফিয়ে গেছি। আগেরদিনের তুষারপাতের বরফের চাদর গলে সোনালী ঘাস সূর্যের আলোয় চকচক
করছে, আর মালবহনকারী ঘোড়াগুলো ওই ঘাস খেয়েই তাদের প্রাতরাশ সেরে নিচ্ছে। প্রায় ১০টা
নাগাদ আমরা লামুনের উদ্দেশ্য রওনা হলাম। পান্ডিমকে ডানদিকে ও কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সামনে রেখে এগিয়ে চল্লাম। আজকের রাস্তা
পুরোটাই সমান ও অনেকটা সহজ, তাই আমাদের গাইড করার জন্য মামাজি ও তাসি কেউ নেই। ওরা
সামনে এগিয়ে আমাদের জন্য টেন্ট ও কিচেন টেন্ট বানাচ্ছে। ১৪,০০০ফিটে হঠাৎ করে
"বারান্দায় রোদ্দুর" শুনে মনটা ভরে গেল। দেখি একদল বাঙালি গোল করে বসে গান
গাইছে, আর কে পায় ? আমরাও ওদের সাথে জুড়ে গেলাম। কিছুক্ষণ ওদের সাথে সময় কাটিয়ে আমরা
লামুনের দিকে এগিয়ে চল্লাম। প্রায় ১টা নাগাদ আমরা পৌঁছে দেখি আমাদের লাঞ্চও রেডি। আজ
রাত ১:৩০টা নাগাদ উঠতে হবে যে, গোএচালা সামিটের জন্য। আজকের আবহাওয়া যেন আরও মনোরম।
বিকেল পর্যন্তও মেঘের কোনো নামডাক নেই। তাসি ভাইয়ের কথামতো বিকেল পর্যন্ত সবাই একসাথে
ডাইনিং টেন্টেই ছিল, কারণ খুব জোরে শীতল হওয়া বইছিলো। কিন্তু বেলাশেষের পান্ডিমের চুড়ায়
সোনালী রং সবাইকে বাইরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করল। যেন একটি স্বর্ণখনি। আজ প্রায় ৬:৩০টার
মধ্যে ডিনারও সেরে ফেল্লাম ডাইনিং টেন্টে। অন্ধকার নেমে আসার পর টেন্টের বাইরে বেরোনোই
দায়। আজ আবার কোজাগরী পূর্ণিমার রাত। ডাইনিং টেন্টের বাইরে বেরিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখে
মনে হলো কেউ যেন টিউব লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে যে রাতে চাঁদের আলোয় এত
সুন্দর লাগতে পারে স্বপ্নেও ভাবিনি। কাল ২টোর মধ্যে বেরোতেই হবে, তারপর সামিট, তার
সাথে প্রায় ১৭কিমি হাটা তাই আর দেরি না করে স্লিপিংবাগে ঢুকে পড়লাম।
এলার্মের
আওয়াজে উঠে পড়লাম ঠিক সময়। সত্যি বলতে ঠান্ডায় ও পরের দিনের সামিটের উত্তেজনায়, এ রাতে
ঠিক করে ঘুম হয়নি। আগের দিনের মতন আজও টেন্টের ভিতর একটা বরফের আস্তরণ হয়ে রয়েছে। তাসি
ভাইয়ের কথা মতন ৫ লেয়ার গরম জামাকাপড় পরে অনেক কষ্ট করে টেন্টের বাইরে বেরোতেই প্রায়
১৫মিনিট লেগে গেলো। প্রায় ৫ মাসের প্ল্যান বাস্তবে রূপান্তরিত করার জন্য সবাই তৈরি।
আজ আমাদের সাথে আরও এক গাইড বন্ধু যাবে, লিম্ব। গোএচালা সামিট আমাদের সবার স্বপ্ন হলেও
তাসি ভাই আমাদের ভালো করে বুঝিয়ে দিলো যে, কখনো কেউ যদি কোনওরকম অস্বস্তি অনূভব করি
ওনাকে যেন জানানো হয়। প্রায় ১৫,০০০ফিট উচ্যতায় রাতে অক্সিজেন লেভেল অনেক কমে যায় বলে
স্বাসকষ্ট হয়, তাই কোনোরকম শারীরিক অসুবিধা হলেই নীচে নেমে আসা আবশ্যক। প্রায় রাত ২:৩০
নাগাদ সবাই আমাদের ট্রেক শুরু করলাম। প্রথম ২কিমি অল্প চড়াই হলেও সমিতি লেক পার করার
পর থেকে চড়াই ভীষণ কঠিন ও কষ্টদায়ক। আমরা সবার থেকে একটু আগেই যাত্রাশুরু করেছি, যাতে
ধীরে ধীরে চল্লেও সূর্যোদয়ের আগে গোএচালা সামিট পৌছে যাই। যদিও সরকারের নির্দেআনুযাই
সত্যিকারের গোএচালা যাওয়া বারণ, তাই ভিউপয়েন্ট-১ ই এখন গোএচালা সামিট নামে পরিচিত।
চলতে চলতে ভীষণ গলা শুকিয়ে যাবার জন্য জল খেতে হচ্ছিল ঘনঘন। কিন্তু প্রায় ৩০মিনিট চড়াইয়ের
পর দেখলাম বোতলের সব জল জমে বরফ হয়ে গেছে। ভগবান যেন ঠিক ওই সময়ই মামাজিকে আমার কাছে
পাঠিয়েছিল। মামাজি ফ্লাক্সের গরম জল আমার বোতলে ঢেলে দেওয়াতে কিছুটা বরফ গলে জল হলো
ও আমি ঐ জল খেয়ে তেষ্টা মেটালাম। বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে এগোতে থাকলাম আমার গন্তব্যের
দিকে। আস্তে আস্তে দেখা দিতে থাকলো কাব্রু পিক ও তারপর কাঞ্চনজঙ্ঘা। দেখে মনে হচ্ছিল
কাঞ্চনজঙ্ঘার উপর কারা যেন হাজার হাজার হ্যালোজেন
মেরে রেখেছে। চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করে কাঞ্চনজঙ্ঘা। চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম
না, কাঞ্চনজঙ্ঘার এই অলৌকিক ও অপার্থিব সৌন্দর্য দেখে। নির্ধারিত সময়ের আগেই আমি পৌঁছে
গেছিলাম গোএচালা সামিট। জীবনে এই মুহুর্তের অনুভূতি হয়তো সবচেয়ে মনোরম ও সন্তোষজনক।
কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার
দিকে। রাতের অন্ধকারে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে জ্বলজ্বল করতে দেখে বোঝাই মুস্কিল যে সকালের আলো
ফুটে গেছে কিনা। আস্তে আস্তে কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখর লালচে হতে শুরু করলো। সুর্যের প্রথম
কিরণ শিখরে পরে এতটাই রমণীয় যে, প্রকৃতির এই মায়াবী রূপ দেখে আমাদের অনেকেই সামিটে
দাঁড়িয়ে শিশুদের মতন কাঁদিয়ে শুরু করে দিয়েছিল। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেলেও -১৫℃ এ সবারই জল জমে বরফ, কিন্তু সাথে
মামাজি আজও ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে এসেছেন। পৃথিবীর যত পাঁচতারা হোটেল থাকুক গিয়ে, এর
থেকে ভালো পরিষেবা দেওয়া সম্ভব নয়, কখনোই নয়। সাধারণত সামিটে ১৫-২০মিনিটের বেশি থাকা
সম্ভব হয় না, কারণ হার কাঁপানো ঠান্ডা হওয়া ও অক্সিজেনের অভাব। কিন্তু আমরা প্রায় ১ঘন্টা
সামিটে কাটাতে পেরেছি, তার একটি কারণ অবশ্যই মামাজির পরিষেবা আরেকটি কারণ আজ এক ফোটাও
হওয়া বইছে না। তাসি ভাই বল্লো সেও প্রথমবার টিম নিয়ে এতক্ষন সামিটে কাটালো। এবার আমাদের
নেমে আসার পালা, ততক্ষনে সূর্যের আলোয় কাব্রু ও কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ
ধপধপে সাদা কাপড়ে মুড়ে রেখেছে। শেষবারের মতন গোএচালাকে বিদায় জানিয়ে নিচে নামা শুরু
করলাম। নিচে নামার সময় বিস্বাসই হচ্ছিলনা যে এই রুট দিয়েই রাতের অন্ধকারে উপরে চড়েছিলাম।
নামার সময় আমাদের চোখে পড়লো একদল ব্লুশিপ। প্রায় ৭:৩০টা নাগাদ আমরা এসে পৌঁছলাম সমিতি
লেক। এটি একটি শান্ত স্নিগ্ধ নীল রঙের হিমবাহ লেক, যাকে লোকাল লোকজন শান্তির প্রতীক
বলে। লেকের উপর বরফে ঢাকা কাব্রু পিকের প্রতিফলন দেখতে দেখতে যে কখন ১ঘণ্টা কেটে গেল,
বুজতেই পারলাম না। সমিতি লেককে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চল্লাম লামুনের উদ্দেশ্য। ওখানে
আমাদের ডাইনিং টেন্টেই আজকের লাঞ্চ করবো। প্রেকচু নদীর পাস দিয়ে হাঁটু সমান বিভিন্ন
রঙের ঝোপঝাঁড়ের মধ্যে দিয়ে রাস্তাটা যে এত সুন্দর, যাবার সময় রাতের অন্ধকারে বুঝিনি।
লামুনেতে পৌঁছে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে প্রথমেই রুকস্যাক গুছিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম। এবার
শেষবারের মতন কাঞ্চনজঙ্ঘাকে বিদায় জানানোর পালা। লামুনে থেকে যত থানসিং এর দিকে এগোতে
থাকলাম, কাঞ্চনজঙ্ঘা আস্তে আস্তে পাহাড়ের পেছনে লোকাতে থাকলো। রাস্তায় যেসব ট্রেকারদের
সাথে দেখা হচ্ছিল সবার মুখেই একটাই কথা 'Congratulation' । আমারও ওনাদেরও 'Best of
Luck' জানিয়ে দিলাম পরের দিনের গোএচালা সামিটের জন্য। কোকচুরাং এ পৌঁছলাম বেলা ২টো
নাগাদ। শরীর যতই ক্লান্ত হোক, কোকচুরাংএর সৌন্দর্য
ট্রেকারস হাট থেকে যেন বের করে আনলো আমাকে। প্রেকচু নদীর সিংহ গর্জন শুনতে শুনতে মাউন্ট
পান্ডিমের উপর দিনের শেষ আলো উপভোগ করার মজাই আলাদা। সন্ধে নেমে আসার সাথে সাথে শরীরও
আর সাথ দিচ্ছিল না, ডিনার খেয়ে ট্রেকার হাটেই আমরা সেদিন রাত কাটালাম।
আজকে কেন
জানিনা সকলেরই মন ভার। প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য ছেড়ে আবার ফিরে যেতে হবে শহরের দৈন্যদিন
জিবিনে, কিন্তু আমাদের হাতে তো আরও দুদিন আছে। ব্রেকফাস্ট সেরে এগিয়ে চল্লাম সোখার
উদ্দেশ্য। ফেডং পর্যন্ত পুরো রাস্তাটাই চড়াই। পাইন গাছের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সরু রাস্তা
আর মাঝে মধ্যে উকি মারছে মাউন্ট পান্ডিম। প্রায় ১২:৩০ নাগাদ আমরা পৌঁছলাম ফেডং, যদিও
যাবার সময় যে মেঘাচ্ছন্ন ফেডং দেখেছি তার সাথে এই ফেডং এর কোনো মিল নেই। ঝলমলে নীল
আকাশ, মেঘের বিন্দুমাত্র নেই, দূরে দেখা যাচ্ছে তেনচেনখাং শৃঙ্গ। বাক্সে করে আনা লাঞ্চটাও
এখানে বসে খেয়ে নিলাম। এবার শুধুই উৎরাই তাই ফ্লিজ জ্যাকেটটা খুলে রুকস্যাকেই রেখে
দিলাম। প্রায় ২:৩০টে নাগাদ আমরা সোখা পৌঁছে গেলাম। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ
টেন্টের ভিতরেই কাটালাম। সূর্য ডোবার সময় বেরিয়ে আসলাম টেন্ট থেকে তাও আবার মামাজির
ডাকে গরম গরম সুপ খেতে। সূর্যাস্তের পরও আকাশ এতটাই পরিস্কার ছিল যে খালি চোখেই আকাশগঙ্গা
দেখা যাচ্ছিল। দূরে পাহাড়ের কোলে টিমটিম করা আলগুলোর সাথে পরিচয় করলো তাসি ভাই, হলুদ
আলোটি হলো দার্জিলিং ও সাদা আলোটি পেলিং। আজ আমাদের জন্য বিশেষ ডিনারের ব্যবস্থা হচ্ছে
জানতাম, কিন্তু ডিনার টেবিলে গিয়ে তো আমাদের চোখ ছানাবড়া। সুপ, মাশরুম ফ্রাইড রাইস,
চিলি পনির, প্যান কেক ও শেষে গুলাব জামুন। শুধু এখানেই শেষ নয়, গোএচালা সামিট সফল হবার
জন্য, চন্দ্রহান আমাদের জন্য চকলেট কেকও বানিয়েছেন। এই অল্টিটিউডে এতো কিছু বানিয়েছে
দেখে সত্যিই সবাই হতবাক। ডিনার শেষে ট্রেক সাফল্যের আনন্দে আমাদের একটু নাচা গানও হলো।
সব পোর্টার বন্ধুরা, কিচেন স্টাফ, মামাজি, লিম্ব, তাসি ভাই আমাদের সাথে যোগ দিল। আমার
কাছে এই ট্রেকে ওনাদের মাহত্য অনেকটাই।সবকিছু গুছিয়ে শুতে শুতে প্রায় ১০টা বেজে গেল।
পরেরদিন
ঝকঝকে নীল আকাশ, সাথে মিষ্টি সূর্যের কিরণে আমাদের ঘুম ভাঙল। দূর থেকে পান্ডিম দেখা
দিলেও আজ আর ছবি তোলার ইচ্ছে কারুর নেই। এই ট্রেকের শেষবারের মতন রুকস্যাক ও টেন্ট
গুছিয়ে প্রাতরাশ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ইয়কসামের উদ্দেশ্য। প্রথম দিনের সেই জঙ্গলের
চেনা পথ দিয়ে নেমে চল্লাম। ইয়কসাম যত কাছে আসছিল মন একটু খারাপ লাগলেও প্রায় ১০দিন
পর বাড়ির লোকেদের সাথে কথা বলতে পাড়বো ভেবেই আনন্দ হচ্ছিল। প্রায় ১:৩০টার মধ্যে ইয়কসাম
পৌঁছে বাড়ির ফোন সেরেই স্নানে চলে গেলাম। বাড়ির সাথে কথা বলার মতন ১০দিন পর স্নান করার
মজাও খুব একটা কম না। তাসি ভাই, মামাজি দেরও এবার বিদায় জানানোর পালা, ওনারাও বাড়ি
যাবেন যদিও সবার বাড়িই ইয়কসামেই। সবাই প্রতিজ্ঞা করলাম, আবার ফিরে আসবো ওই রুটে। রাতে
ইয়কসামের এক রেস্তোরাঁয় আমরা বন্ধুরা ট্রেক সাফল্য উৎযাপন করলাম লোকাল পানীয় তংমার
সাথে। গোএচালার বিভিন্ন মুহূর্তের স্মৃতি রোমন্থনের সাথে আলোচনায় থাকলো পরবর্তী ট্রেকের
প্ল্যান।
পরেরদিন
সকাল সকাল গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্য। রাতে দার্জিলিং মেইল ধরে
কলকাতা, সাথে রইলো গোএচালা টেকের অনেক স্মৃতি।
No comments:
Post a Comment