ধূসর
পাহাড়, অনাবিল সৌন্দর্য, উপত্যকার উপরে মেঘ ও রোদের খেলা,
নীল হ্রদের সাথে আকাশের সংমিশ্রণ আর অপার নিস্তব্ধতা - এই শব্দ গুলো শুনলে শুধু একটি জায়গার কথাইমনে পরে যায় আর সেটা হলো রোহমর্শক সৌন্দর্যে ভরা "লাদাখ". ফোটোগ্রাফি র সাধ তা
আমার অনেকদিনের ই. তাই যখন ই সুযোগ পাই
বেরিয়ে পড়ি প্রকৃতির টানে. সাম্প্রতিক সময়ে সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং ভ্রমণ সম্পর্কিত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বিশেষত "ভ্রমণ" পত্রিকাতে লাদাখ সম্পর্কে অনেক কিছুই পরে নিয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না. ভ্রমণএর জুন মাসের সংস্করণে লাদাখ নিয়ে লেখা দেখে এবার ঠিকই করে নিলাম যাওয়া টা. প্রতিবারের মতো এবারও আমি নিজেই পরিকল্পনা শুরু করে দিলাম. লাদাখে প্রকৃতির প্রতিটি মুহূর্তউপভোগ করার জন্য যা সব থেকে জরুরি তা হলো ফিজিক্যাল ফিটনেস. সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০,০০০ ফুটের
বেশি উঁচু যেকোনো জায়গাতেই আল্টিটিউড সিকনেস এর প্রবণতা থেকেইযায়. তার জন্য রোজ ৫ কিমি করে
প্রাতঃভ্রমণ এবং ২তলা সিঁড়ি দিয়ে ১০ বার ওঠা নামা করলে শারীরিক সক্ষমতা বাড়ে এবং হৃদয়ও
শক্ত সমর্থ হয়. তাই আমরাও এই প্রকার কসরতশুরু করে দিলাম. আর যারা লাদাখ এ ঘুরে বা
ট্রেক করে এসেছে, তাদের থেকে জেনে নিলাম ডিয়ামক্স ও কোকাবোরা নামক
দুটি ওষুধের কথা, যা লাদাখ পৌঁছানোর দুদিন আগে থেকেখাওয়া উচিত.
Tso-Moriri Lake |
তথ্য প্রযুক্তিতে কাজ করার জন্য আমাদের কারোর পক্ষেই বেশিদিনের ছুটি পাওয়াটা সম্ভব ছিল না. মানালি হয়ে লাদাখ যাবার রাস্তা অপূর্ব হলেও আমরা বিমানে করেই লে যাবো ঠিককরলাম. তাই দেরি না করে সবার আগে বিমানের টিকেট কেটে নিলাম. এবার প্ল্যান বানানোর পালা, তাই ঠিক কোথায় কোথায় যাবো ঠিক করে নিলাম. ভ্রমণ কে পথপ্রদর্শক করেইআমরা ঠিক করলাম প্যাংগং সরোবর, নুব্রা ভ্যালি এবং সো মোরিরি. লে তে থাকার জন্য আবু প্যালেস, নুব্রা ভ্যালি তে থাকার জন্য লামিজিং গেস্ট হাউস, সো মোরিরি তে লেক ভিউগেস্ট হাউস এবং প্যাংগং এর ধারে স্পাগমিক নামক একটি গ্রামে টেন্ট ভাড়া করে নিলাম. আর ঠিক করা হলো আমাদের সাথে ৮ দিন একটি গাড়ি ও ড্রাইভার থাকবেন যিনিই হবেন আমাদের গাইড. আস্তে আস্তে আমাদের যাত্রার দিন উপস্থিত হলো. আমরা কলকাতা থেকে সকালের বিমানে চলে গেলাম দিল্লি. লে বিমানবন্দর সকাল ১০টা পর্যন্ত যাত্রীদের জন্য খোলা থাকে, তাইএকদিনে কলকাতা থেকে লে যাওয়া যায় না. আমরা দিল্লি তে একদিন থেকে পরের দিন সকাল ৫:৩০ র বিমান ধরে লে এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম. বিমান দিল্লি থেকে ছাড়ার পরেইসুদূরের পর্বত শৃঙ্গ দৃশ্যমান হলো. প্রথমে মেঘ বলে ভুল করলেও সূর্যোদয়ের আগে বুঝলাম সেগুলি আসলে পর্বত শৃঙ্গ. সেই পর্বত শৃঙ্গের পেছন দিয়েই সূর্যোদয়ের যে নৈস্বর্গিক রূপদৃশ্যমান হলো তা বোধহয় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভুলবো না. আমাদের বিমানে একজন হিমালয় বিশেষজ্ঞ কিছু শৃঙ্গকে সনাক্ত করতে সাহায্য করলো. নিচের সবুজ পাহাড় গুলোকিছুক্ষনের মধ্যেই বরফের চাদরে ঢেকে গেল এবং এক অপরূপ মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করলো. বিমানে বসে উপর থেকে হিমালয়ার এই সৌষ্ঠবপূর্ণ দৃশ্য দেখে মানালি হয়ে লাদাখ যাবারআপসোস অনেকটাই কমে গেলো. কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের বিমান চালক বললেন আমরা লে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে চলেছি. চারদিকে তুষার শিখর পর্বতের মাঝখান দিয়ে ল্যান্ডিংকোনো অভিজ্ঞ পাইলটের দ্বারাই সম্ভব. চারিদিকের অপূর্ব ভূদৃশ্য দেখতে দেখতে কুশক বাকুলা রিমপোচে বিমানবন্দর (লে এয়ারপোর্ট) এ আমাদের বিমান অবতরণ করলো.
লে তে নেমেই অক্সিজেন এর অভাব অনুভব করতে পারছিলাম. লাগেজ সংগ্রহ করে আমাদের ড্রাইভার কে ডাকলাম, তিনি আমাদের জন্য বিমান বন্দরের সামনেই অপেক্ষা করছিলেন.বলে রাখাই বাহুল্য যে লাদাখ এ BSNL এবং Airtel এর পোস্টপেইড কানেকশন পাওয়া যায়. তাই আমরা এই দুটি সিম কার্ড নিয়েই এসেছিলাম. বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে অল্প বৃষ্টি হলেওড্রাইভার বৃষ্টি কমে যাবে বলে আস্বস্ত করলেন. আবু প্যালেস পৌঁছতে পৌঁছতে সত্যিই বৃষ্টি বন্ধ হয়ে নীল আকাশে সাদা তুলোর মতন মেঘ ভেসে বেড়াতে দেখলাম. বিশেষজ্ঞদের মতেলাদাখের প্রথম দিনটা বিশ্রাম করে ও অল্প স্বল্প হাটাচলা করা উচিত. পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেবার জন্য প্রথম দিন দূরে কোথাও যেতে নেই. হোটেলের সামনের বাগানে ১ ঘণ্টা বসেগল্প করে কাটিয়ে ঠিক করলাম এই নৈস্বর্গিক পরিবেশ একটু ঘুরে দেখা উচিত. আমাদের হোটেলের পাশেই একটি ছোট পাহাড়ের উপর একটা গুমফা দেখা যাচ্ছিলো. গুমফা হলো একতিব্বতি মন্দির. আমাদের মধ্যে ৩ জন ঠিক করলাম আজ আমরা গুমফা টি দেখে আসবো. গুমফা কি যতটা কাছে লাগছিলো, অতটাও কাছে ছিল না. উপরে উঠতে বেশ কষ্ট হলেও,ওঠার পর লে শহরের যে প্যানোরামিক দৃশ্য দেখা গেলো তাতে সব কষ্ট দুর হয়ে গেলো. পুরো লের উপর দিয়ে যেন আলো ছায়ার খেলা চলছে. সেখান থেকে শান্তি স্তুপা, লে প্যালেস, স্টককাংড়ি রেঞ্জ দেখা যাচ্ছিলো. সন্ধ্যে হবার আগে আমরা নিচে নেমে আসলাম. রোদ পড়ার সাথে সাথে ঠান্ডাটা বহু গুন্ বেড়ে গেছিলো. সেদিন সন্ধ্যে বেলাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়েওপড়লাম.
Leh Palace |
পরের দিন আমাদের লোকাল সাইট সিন দেখার কথা. লাদাখে অনেক মনেস্ট্রি মানে বৌদ্ধ মন্দির আছে যেখানে তিব্বতি সন্ন্যাসীদের থাকার ব্যবস্থা আছে. যেমন ঠিকসে মনেস্ট্রি,স্পিটুক মনেস্ট্রি, স্ট্যাকনা মনেস্ট্রি, মাথো মনেস্ট্রি. এদের সবাই মধ্যে আমার সবথেকে ভালো লাগলো ঠিকসে মনেস্ট্রি. ঠিকসে এর উপর থেকে সামনের উপত্যকার দৃশ্য অভূতপূর্ণ.ঘুরতে ঘুরত 3 idioits এ দেখানো লাদাখের স্কুল টিও দেখে নিলাম. এরপর আমরা ইন্ডাস নদীর ধারে একটি ফাঁকা জায়গা দেখে লাঞ্চ টা সেরে নিলাম. লাদাখের ভূদৃশ্য কে যেন প্রতি মুহূর্তে নতুন করে খুঁজে পাওয়া যায়. প্রতিটি মুহূর্তই সে যেন অসাধারণ. লাঞ্চ সেরে আমরা এগিয়ে গেলাম ম্যাগনেটিক হিল এর দিকে. এই জায়গাটি শ্রীনগর হাইওয়ের উপরে অবস্থিত. গাড়িথেকে নেমে যখন আমরা ম্যাগনেটিক হিল এর সৌন্দর্য উপভোগ করছি, আমাদের ড্রাইভার বোঝালো কেন জায়গাটার নাম ম্যাগনেটিক হিল. চুম্বকার্শিত পদার্থরা এই পাহাড়ের দিকে অনায়াসেই আকর্ষিত হয়ে এগিয়ে চলে.এই পরিস্থিতি টা practically বোঝানোর জন্য আমাদের ড্রাইভার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে গাড়িটিকে ওই পাহাড়ের দিকে মুখ করে রাখলেন. আমরা আশ্চর্যান্বিত হয়ে দেখলাম গাড়িটি স্বতঃফূর্ত ভাবে মাধ্যাকর্ষণকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চললো. তারপর দেখলাম অনেকেই আমাদের মতো ওই জায়গায় এসে গাড়িবন্ধ করে প্রকৃতির এই অদ্ভুত আচরণকে উপভোগ করছে .এরপর আমরা লে এর দিকে ফিরে আসছিলাম, হঠাৎ আমাদের ড্রাইভার দেখালেন, রাস্তার ধারে যে মাটি কাটা হচ্ছে সেটি নাকিমুলতানি মাটি. ব্যাস, মুলতানি মাটির নাম শুনে অনেকেই গাড়ি থেকে নেমে প্যাকেট করে কিছু মাটি তুলে নিলো. আর ও ৩০ মিনিট যাত্রার পরে আমরা হোটেলে পৌঁছে গেলাম. রাতেএকবার লে বাজারটাও ঘুরে দেখে নিলাম. আগামীকাল থেকে আমাদের আসল ঘোরা শুরু - গন্তব্যস্থল নুব্রা ভ্যালি.
Nubra valley |
সকাল সকাল উঠে ব্রেকফাস্ট সেরেই তৈরী হয়ে গেলাম নুব্রা ভযালি যাওয়ার জন্য. আজ আমরা আরো একটি কারণে আবেগকম্পিত, কারণ আজ আমরা পৃথিবীর সর্বোচ্চ মোটরগাড়িচলার রাস্তা দিয়ে যাবো - খারদুংলা পাস(১৮,৩৮০ ফুট). সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেকটা উঁচু হবার জন্য অক্সিজেন এর মাত্রা এখানে ১০%. তাই লে ছাড়ার আগে ২টি অক্সিজেন এর সিলিন্ডারকিনে রাখলাম. চড়াই রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে ২ ঘন্টায় আমরা খারদুংলা পৌঁছে গেসিলাম. চারদিকে শুধু সাদা বরফ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না. অল্প অল্প তুষারপাত তখনওহচ্ছিলো, তাই আমরা গাড়ি থেকে নেমে একটু তুষারপাত উপভোগ করে নিলাম. অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকার জন্য আমাদের একটু কষ্ট হচ্ছিলো তাই আমরা এগিয়ে চললাম নুব্রাভ্যালির দিকে. সায়ক নদীর পার দিয়ে চলতে চলতে আরও ৩ঘন্টা পর আমরা গিয়ে পৌঁছলাম নুব্রা ভ্যালি. প্রথমে আমরা সমস্যানলিং গুমফা তে গিয়ে আমাদের লাঞ্চটা সেরে নিলাম.তারপর গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম হুন্ডারে. হুন্ডার এক অদ্ভুত জায়গা যেখানে সবুজ গাছ, মরুভূমি আর তুষারে ঢাকা পাহাড় একসাথে দেখা যায়. হোটেলে মালপত্তর রেখে চলে গেলামমরুভূমির দিকে. এই মরুভূমিতে এক বিশেষ প্রকারের ব্যাকটেরিয়াল উটের সওয়ারী হয়. আমাদের মধ্যে কিছু লোক গেলো সেই সওয়ারী নিতে. আমি ক্যামেরা নিয়ে এগিযে গেলামপ্রকৃতির এই অদ্ভুত বৈপরীত্বকে ক্যামেরা বন্দি করার জন্য. আমার জানার মধ্যে হুন্ডার হয়তো একমাত্র জায়গা যেখানে মরুভূমি গিয়ে শেষ হয়েছে বরফে ঢাকা পাহাড়ে. সন্ধ্যে পর্যন্তমরুভূমিতে কাটিয়ে আমরা লামিজিং গেস্ট হাউসে ফিরে আসলাম. আমাদের জন্য সুন্দর বন-ফায়ার এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং সাথে সাথে সারা রাতব্যাপি আমাদের গান বাজনাওচললো. নুব্রা ভ্যালির উচ্চতা লে এর থেকে একটু কম বলে হয়তো এখানে তেমন শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো না বা হয়তো এখানকার জলবায়ুর সাথে আমাদের শরীর কিছুটা অভ্যস্তই হয়ে পড়েছে. আগুনের পাশে বসে আমরা সবাই মিলে রাতের খাবার টা সেরে ঘুমের রাজ্যে ঢোলে পড়লাম. পরের দিন সকাল সকাল উঠে চারিপাশটা একটু ঘুরে আসলাম. ব্রেকফাস্ট সেরে আমরাআবার লে যাবার পথে এগিয়ে চললাম. ফেরার সময়ে ডিস্কিট মনেস্ট্রি ও দেখে নিলাম. ডিস্কিট মনেস্ট্রি হলো নুব্রা ভ্যালির সব থেকে বড়ো বুদ্ধিস্ট মনেস্ট্রি. এর সামনে ৩২ মিটারের উঁচুমৈত্রেয়ী বুদ্ধের এক অভূতপূর্ণ স্থাপত্য বিরাজ করছে. এখান থেকে নুব্রা ভ্যালির প্যানোরামিক সৌন্দর্য সত্যিই হাতে আঁকা ছবির মতো মনে হয়. ফেরার সময়ে খারদুংলা পাসে তুষারপাতহচ্ছে না বলে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সেই শ্বেতশুভ্র রূপ উপভোগ করলাম. ওখানে কিছু ভিনদেশি পর্যটকের সাথে আলাপ হলো আমাদের যারা সাইকেল নিয়ে নুব্রা ভ্যালি যাচ্ছে.ওনাদের সাথে কথা বলে,ওনাদের দক্ষতার কথা স্মরণ করে সত্যিই মন ভোরে যায় আর নিজেদের মধ্যে দুঃসাহসিক অভিযান এর স্পীহা বেড়ে যায়.. এখানে বেশিক্ষন কাটালেই মাথাধরতে শুরু করে , তাই আমরা আর বেশি দেরি না করে লে তে চলে আসলাম. আজ সন্ধ্যে বেলা তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম.
পরের দিন আমাদের গন্তব্যস্থল হলো প্যাংগং সরোবর. এটি সেই প্যাংগং সরোবর যেখানে শাহরুখ খান, আমির খান দের সিনেমায় দেখেছি. লাদাখে প্যাংগং সরোবরই পর্যটকদের শ্রেষ্ঠআকর্ষণ. প্যাংগং সরোবরের (১৪,২৭০ ফুট) ৪০% অংশ ভারতে এবং ৬০% চিনে. লবনাক্ত হ্রদ হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু শীত কালে পুরো সরোবরটি বরফে রূপান্তরিত হয়ে যায়. সকাল ৮টানাগাদ আমারদের গাড়ি চলে আসলো ও আমরা ইন্দাস নদীর পার ধরে এগিয়ে চললাম হেমিসের দিকে. হেমিসে এসে আমরা আমাদের ব্রেকফাস্টও করে নিলাম. এবার কিছু নিরাপত্তাপরীক্ষা করে আমরা এগিয়ে চললাম ছাঙলা পাস (১৭,৫৯০ ফুট) এর দিকে. ছাঙলা পাস পৌঁছতে পৌঁছতে আর ও ২ঘন্টা লেগে গেলো. খারদুংলা পাস এর মতন এখানেও অক্সিজেনেরমাত্রা খুব কম বলে বেশিক্ষন ছাঙলা পাসে না কাটিয়ে সামনে এগিয়ে চললাম. হেমিস থেকে প্যাংগংয়ের পথে অনেক পর্যটকের সাথে দেখা হলো আমাদের. কেউ দিল্লী, কেউ কলকাতা,কেউ বা বেঙ্গালুরু থেকে বাইক নিয়ে এসেছে. পুরো রাস্তা জুড়ে ধূসর পাহাড়ের উপর মেঘ ও রোদের খেলা দেখতে দেখতেই সময়ে কেটে গেলো. মাঝে মধ্যেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রকৃতিরএই সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দি করে নিলাম. একটি জলাধারের পাশে এসে আমাদের ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করালেন. এখানে নাকি মার্মাট নামক এক প্রকার প্রাণী মাটির নিচেই বসবাস করে.তারা পর্যটকে দের থেকে খাবার পাবার লোভে রাস্তার ধারে এসে দাঁড়িয়ে থাকে. আমরা গাড়ি থেকে নেমেই দেখলাম অনেক মার্মাট একটি মাঠে ছুটে বেড়াচ্ছে. আমাদের কৌতূহল বেড়েগেলো . মার্মাটগুলোকে কাছ থেকে দেখার জন্য আমরা সামনে এগিয়ে গেলাম. ছোট্ট প্রাণীগুলোকে সামনে থেকে দেখতে ভীষণ অবাক লাগছিলো, কারণ ওদের আচরণ দেখে মনেহচ্ছিলো ওরা আমাদের বহুবছর ধরে চেনে. বিস্কুটের লোভে পারলে আমাদের কোলে উঠে আসে. আর দেরি না করে আমরা এগিয়ে চললাম প্যাংগংয়ের দিকে. দুপুর ১টা নাগাদ আমরালক্ষ করলাম ধূসর পাহাড়ের মধ্য দিয়ে একটি নীল হ্রদ উঁকি মারছে. সবাই বুঝতে পারলাম যে আমরা আমাদের গন্তব্যস্তলে পৌঁছে গেছি. আর ৩০মিনিটের মধ্যেই আমরা প্যাংগংসরোবরের ধারে পৌঁছে গেলাম. সত্যিই যেন প্রকৃতির ক্যানভাসে ভগবানের রঙ্গিন তুলি টান. রুক্ষ পাহাড়ের বুকে এমন নীল রঙের সরোবরের মোহময় রূপ সবাইকে যেন বাকরুদ্ধ করেদেয়. সরোবরের ধরেই আমাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা করা ছিল. লাঞ্চ করে সরোবরের ধার দিয়েই আমরা এগিয়ে চললাম স্প্যাংমিকের দিকে, ওখানেই আজ আমাদের টেন্টের ব্যবস্থা করেহয়েছে. টেন্টে পৌঁছানোর পর হঠাৎ বৃষ্টি হবার জন্য সবার একটু মন খারাপ হলেও ৩০ মিনিটের মধ্যেই আবার ঝকঝকে রোদ্দুর সবার মন ভরিয়ে দিলো. সময় নষ্ট না করে ক্যামেরানিয়ে হাটতে হাটতে প্যাংগং সরোবরের ধারে চলে গেলাম. স্প্যাংমিক একটি ছোট গ্রামের মতো. কিছু স্থানীয় বাসিন্দাকে চাষবাস করতেও দেখা গেলো. সরোবরের উপর আলো ছায়ারলুকোচুরি ক্যামেরাবন্দি করে নিলাম বাকি জীবনের স্মৃতির জন্য. সূর্যের শেষ কিরণ পর্যন্ত আমরা সরোবরের পাশে বসেই কাটালাম. সূর্যাস্তের পর তেমন কিছু করার থাকেনা বলে আমরাটেন্টে ফিরে আসলাম. বাইরে ভীষণ হাওয়া বইলেও, টেন্টের ভিতরে অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক. কফির কাপে চুমুক দিয়ে সবাই মিলে আড্ডা মেরে কাটালাম. রাত ৮টা নাগাদ ডিনারকরতে টেন্ট থেকে বেরিয়ে দেখলাম সারা আকাশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ তারা ঝিকিমিকি. জীবনে প্রথমবার নিজের চোখে আকাশগঙ্গা দেখে বিস্মিত হয়ে গেলাম. ডিনার সেরে তাড়াতাড়ি শুয়েপড়লাম কারণ পরেরদিন সকালের সূর্যোদয় দেখার অভিজ্ঞতাটা ছাড়া যাবে না. পরেরদিন সূর্যোদয়ের আগেই ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, আমাদের টেন্টের উপর বরফের একটা পাতলাআস্তরণ পরে গেছে. টেন্টের সামনেই চা এর কাপে মুখ দিয়ে সকালের সূর্যোদয় উপভোগ করলাম সবাই মিলে. এবার ফেরার পালা. ব্রেকফাস্ট করে প্যাংগংয়ের মোহ ছাড়ার আগেশেষবারের মতন দেখে নিলাম প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্যকে. শেষবারের মতন প্যাংগং সরোবরকে দেখে সবার মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেছিলো. আগের দিনের রাস্তা দিয়েই প্রকৃতির এইঅপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে সন্ধ্যের মধ্যে আমরা লে পৌঁছে গেলাম.
লাদাখে এসে সো মোরিরি না দেখে গেলে লাদাখ যাত্রা কখনোই সম্পূর্ণ হয় না. সো মোরিরি লাদাখ থেকে 200 কিমি দক্ষিণে এবং উচ্ছতায় (14836 ft) - প্যাংগং সরোবর থেকে কিছুটাবেশি. সো মোরিরি লাদাখের উচ্চতম সরোবর. এই সরোবর সম্পর্কে খুব বেশি না জানলেও, ইন্টারনেটে যেটুকু পড়েছি তাতে আমি সো মোরিরি দেখার জন্য সব চেয়ে বেশি আগ্রহীছিলাম. এই দিন আমরা সকাল 7 টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম. আমাদের ড্রাইভার বললো আজকের রাস্তা সব থেকে দীর্ঘতম এবং সব থেকে সুন্দর. লে থেকে বেরিয়েই আমরা ইন্দাসনদীকে ডান রেখে এগিয়ে চললাম. পুরো রাস্তাতে ইন্দাস নদী আমাদের অনুসরণ করছে. এগোতে এগোতে কখন জানি ধূসর পাহাড় গুলো গোলাপি রঙের হয়ে গেছে বুঝতেই পারলাম না.আবার কখনো নীলচে, কখনো বা সবুজ. পাহাড়ের এতো রকম রং দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়. এখন বুঝলাম কেন পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ বাইক নিয়ে মানালিথেকে লে আসে. এই ঐশ্বারিক সৌন্দর্যকে যেন কোনোভাবেই চোখের আড়াল হতে দেওয়া যায়না. প্রায় 4 ঘন্টা পর আমরা পৌঁছলাম চুমথাং. এখানে এবার আমাদের ইন্দাস নদীকেবিদায়ে জানানোর পালা. কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে এবং কিছু খেয়ে আমরা এগিয়ে চললাম সো মোরিরির দিকে. কিছুক্ষন পর দূরে একটা সরোবর দেখে উৎসাহিত হয়ে আমরা আমাদেরড্রাইভার কে জিজ্ঞাসা করলাম, আমরা কি পৌঁছে গেছি ? উনি বললেন এটি হলো কায়াগার সরোবর. সত্যিই এই জীবনে এতো সুন্দর জায়গা আমি দেখিনি. চারিদিকে ধূসর পাহাড়েরউপর সবুজ আভা, একটু দূরে বরফের পাহাড়ের শৃঙ্গ এবং মাঝে একটি শান্ত নীল হ্রদ. হ্রদ এর পশে কিছু তিব্বতি গাধা চড়ে বেড়াচ্ছে. মনে হচ্ছিলো এখানেই টেন্ট বানিয়ে থেকে যাই,কিন্তু আমাদের বুকিং আছে সো মোরিরি তে তাই এগিয়ে চললাম. আর 30 মিনিটের মধ্যেই সো মোরিরির চেকপোস্ট এ পৌঁছে গেলাম. সো মোরিরির পাশে কার্জক নামে একটি ছোটগ্রাম, সেখানেই আজ রাত্রে থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম. এখানকার লোকেরা সো মোরিরির তীরে চাষবাস করে জীবনযাপন করেন. এখানকার সৌন্দর্য যা ভেবেছিলাম তার থেকে বহুগুনবেশি. সামনে সবুজ, হলুদ, লাল রঙের ক্ষেত. এরপর নীল হ্রদ আর ওপারে ধূসর পাহাড় এবং তার উপর দিকে বরফ. ভারত তো দূরের কথা, আমি স্বপ্নেও কখোনো কল্পনা করিনি যেপৃথিবী তে এতো সুন্দর জায়গা বিদ্যমান. কিছুক্ষন বিশ্রাম নেবার পর আমাদের ড্রাইভার সো মোরিরির সামনের দিকে নিয়ে গেলো. সেখান থেকে কর্জক গ্রামটির সৌন্দর্য অভূতপূর্ণ. কিন্তুআজ প্রকৃতি আমাদের সাথে ছিল না. হঠাৎ বৃষ্টি আসার জন্য আজকের মতন আমরা হোটেল এ ফিরে গেলাম. লম্বা জার্নির জন্য আজ আমরা সবাই খুব ক্লান্ত, তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়েপড়লাম. পরের দিন ভোর হবার আগেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ক্ষেতের ভিতর দিয়ে. দূরে বরফে ঢাকা পাহাড়ের পিছন দিয়ে সূর্যোদয় অভূতপূর্ণ. আস্তে আস্তে সূর্যের আলো গ্রামএর উপর এসে পড়ায় বেশ আরামই লাগছিলো. বিভিন্ন রকমের গবাদি পশুরা চারিদিকে চড়ে বেড়াচ্ছে, গ্রামের ছোট থেকে বড় সবাই চাষবাস করতে চলে আসে এই ক্ষেতে. কিছুক্ষনসরোবর তীরে কাটিয়ে হোটেলে ফিরে আসলাম বিস্ময়কর প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য দেখে. ব্রেকফাস্ট খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম লের দিকে. ফেরার সময়ে প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ দেখতেদেখতে ঠিক করলাম, এখানে আবার ফিরে আসতেই হবে.
লে তে ফিরে আসতে আসতে আবহাওয়া একটু খারাপ হয়ে গেছিলো. হোটেল পৌঁছতে পৌঁছতে জোর বৃষ্টিও শুরু হয়ে যায়. পরের দিন সকালই ফ্লাইট বলে একটু ভয়ই লাগছিলো. ব্যাগগুছিয়ে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম সেদিনের মতন. পরেরদিন সকালেও আবহাওয়া এতটুকুও ঠিক হলো না. এয়ারপোর্ট-এ গিয়ে জানলাম আজকের সব ফ্লাইট বাতিল. হয়তোলাদাখ কে বড্ড বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি, তাই ভগবানও চায় একদিন বেশি থেকে যাই. যাইহোক, আবার হোটেলে ফিরে এসে পরের দিনের ফ্লাইটে আমরা দিল্লী চলে আসলাম. দিল্লীথেকে বিকালের ফ্লাইটে কলকাতা.
No comments:
Post a Comment