Monday 16 April 2018

ধূসর পাহাড়ের দেশে


ধূসর পাহাড়, অনাবিল সৌন্দর্য, উপত্যকার উপরে মেঘ রোদের খেলা, নীল হ্রদের সাথে আকাশের সংমিশ্রণ আর অপার নিস্তব্ধতা - এই শব্দ গুলো শুনলে শুধু একটি জায়গার কথাইমনে পরে যায় আর সেটা হলো রোহমর্শক সৌন্দর্যে ভরা "লাদাখ". ফোটোগ্রাফি সাধ তা আমার অনেকদিনের . তাই যখন সুযোগ পাই বেরিয়ে পড়ি প্রকৃতির টানে. সাম্প্রতিক সময়ে সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং ভ্রমণ সম্পর্কিত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বিশেষত "ভ্রমণ" পত্রিকাতে লাদাখ সম্পর্কে অনেক কিছুই পরে নিয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না. ভ্রমণএর জুন মাসের সংস্করণে লাদাখ নিয়ে লেখা দেখে এবার ঠিকই করে নিলাম যাওয়া টা. প্রতিবারের মতো এবারও আমি নিজেই পরিকল্পনা শুরু করে দিলাম. লাদাখে প্রকৃতির প্রতিটি মুহূর্তউপভোগ করার জন্য যা সব থেকে জরুরি তা হলো ফিজিক্যাল ফিটনেস. সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০,০০০  ফুটের বেশি উঁচু যেকোনো জায়গাতেই আল্টিটিউড সিকনেস এর প্রবণতা থেকেইযায়. তার জন্য রোজ কিমি করে প্রাতঃভ্রমণ এবং ২তলা সিঁড়ি দিয়ে ১০ বার ওঠা নামা করলে শারীরিক সক্ষমতা বাড়ে এবং  হৃদয়ও শক্ত সমর্থ হয়. তাই আমরাও এই প্রকার কসরতশুরু করে দিলাম. আর যারা লাদাখ ঘুরে বা ট্রেক করে এসেছে, তাদের থেকে জেনে নিলাম ডিয়ামক্স কোকাবোরা নামক দুটি ওষুধের কথা, যা লাদাখ পৌঁছানোর দুদিন আগে থেকেখাওয়া উচিত.

Tso-Moriri Lake


তথ্য প্রযুক্তিতে কাজ করার জন্য আমাদের কারোর পক্ষেই বেশিদিনের ছুটি পাওয়াটা সম্ভব ছিল নামানালি হয়ে লাদাখ যাবার রাস্তা অপূর্ব হলেও আমরা বিমানে করেই লে যাবো ঠিককরলামতাই দেরি না করে সবার আগে বিমানের টিকেট কেটে নিলামএবার প্ল্যান বানানোর পালাতাই ঠিক কোথায় কোথায় যাবো ঠিক করে নিলামভ্রমণ কে পথপ্রদর্শক করেইআমরা ঠিক করলাম প্যাংগং সরোবরনুব্রা ভ্যালি এবং সো মোরিরিলে তে থাকার জন্য আবু প্যালেসনুব্রা ভ্যালি তে থাকার জন্য লামিজিং গেস্ট হাউসসো মোরিরি তে লেক ভিউগেস্ট হাউস এবং প্যাংগং এর ধারে স্পাগমিক নামক একটি গ্রামে টেন্ট ভাড়া করে নিলামআর ঠিক করা হলো আমাদের সাথে  দিন একটি গাড়ি  ড্রাইভার থাকবেন যিনিই হবেন আমাদের গাইড. আস্তে আস্তে আমাদের যাত্রার দিন উপস্থিত হলোআমরা কলকাতা থেকে সকালের বিমানে চলে গেলাম দিল্লিলে বিমানবন্দর সকাল ১০টা পর্যন্ত যাত্রীদের জন্য খোলা থাকেতাইএকদিনে কলকাতা থেকে লে যাওয়া যায় নাআমরা  দিল্লি তে একদিন থেকে পরের দিন সকাল :৩০  বিমান ধরে লে এর উদ্দেশ্যে রওনা হলামবিমান দিল্লি থেকে ছাড়ার পরেইসুদূরের পর্বত শৃঙ্গ দৃশ্যমান হলোপ্রথমে মেঘ বলে ভুল করলেও সূর্যোদয়ের আগে বুঝলাম সেগুলি আসলে পর্বত শৃঙ্গসেই পর্বত শৃঙ্গের পেছন দিয়েই সূর্যোদয়ের যে নৈস্বর্গিক রূপদৃশ্যমান হলো তা বোধহয় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভুলবো নাআমাদের বিমানে একজন হিমালয় বিশেষজ্ঞ কিছু শৃঙ্গকে সনাক্ত করতে সাহায্য করলোনিচের সবুজ পাহাড় গুলোকিছুক্ষনের মধ্যেই বরফের চাদরে ঢেকে গেল এবং এক অপরূপ মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করলোবিমানে বসে উপর থেকে হিমালয়ার এই সৌষ্ঠবপূর্ণ দৃশ্য দেখে মানালি হয়ে লাদাখ যাবারআপসোস অনেকটাই কমে গেলোকিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের বিমান চালক বললেন আমরা লে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে চলেছিচারদিকে তুষার শিখর পর্বতের মাঝখান দিয়ে ল্যান্ডিংকোনো অভিজ্ঞ পাইলটের দ্বারাই সম্ভবচারিদিকের অপূর্ব ভূদৃশ্য দেখতে দেখতে কুশক বাকুলা রিমপোচে বিমানবন্দর (লে এয়ারপোর্ট আমাদের বিমান অবতরণ করলো.


View from Delhi Leh Flight


লে তে নেমেই অক্সিজেন এর অভাব অনুভব করতে পারছিলামলাগেজ সংগ্রহ করে আমাদের ড্রাইভার কে ডাকলামতিনি আমাদের জন্য বিমান বন্দরের সামনেই অপেক্ষা করছিলেন.বলে রাখাই বাহুল্য যে লাদাখ  BSNL এবং Airtel এর পোস্টপেইড কানেকশন পাওয়া যায়তাই আমরা এই দুটি সিম কার্ড নিয়েই এসেছিলামবিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে অল্প বৃষ্টি হলেওড্রাইভার বৃষ্টি কমে যাবে বলে আস্বস্ত করলেনআবু প্যালেস পৌঁছতে পৌঁছতে সত্যিই বৃষ্টি বন্ধ হয়ে নীল আকাশে সাদা তুলোর মতন মেঘ ভেসে বেড়াতে দেখলামবিশেষজ্ঞদের মতেলাদাখের প্রথম দিনটা বিশ্রাম করে  অল্প স্বল্প হাটাচলা করা উচিতপরিবেশের সাথে মানিয়ে নেবার জন্য প্রথম দিন দূরে কোথাও যেতে নেইহোটেলের সামনের বাগানে  ঘণ্টা  বসেগল্প করে কাটিয়ে ঠিক করলাম এই নৈস্বর্গিক পরিবেশ একটু  ঘুরে দেখা উচিত.  আমাদের হোটেলের পাশেই একটি ছোট পাহাড়ের উপর একটা গুমফা দেখা যাচ্ছিলোগুমফা হলো একতিব্বতি মন্দিরআমাদের মধ্যে  জন ঠিক করলাম আজ আমরা গুমফা টি দেখে আসবোগুমফা কি যতটা কাছে লাগছিলোঅতটাও কাছে ছিল নাউপরে উঠতে বেশ কষ্ট হলেও,ওঠার পর লে শহরের যে প্যানোরামিক দৃশ্য দেখা গেলো তাতে সব কষ্ট দুর হয়ে গেলোপুরো লের উপর দিয়ে যেন আলো ছায়ার খেলা চলছেসেখান থেকে শান্তি স্তুপালে প্যালেসস্টককাংড়ি রেঞ্জ দেখা যাচ্ছিলোসন্ধ্যে হবার আগে আমরা নিচে নেমে আসলামরোদ পড়ার সাথে সাথে ঠান্ডাটা বহু গুন্ বেড়ে গেছিলোসেদিন সন্ধ্যে বেলাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়েওপড়লাম


Leh Palace


পরের দিন আমাদের লোকাল সাইট সিন দেখার কথালাদাখে অনেক মনেস্ট্রি মানে বৌদ্ধ মন্দির আছে যেখানে তিব্বতি সন্ন্যাসীদের থাকার ব্যবস্থা আছেযেমন ঠিকসে মনেস্ট্রি,স্পিটুক মনেস্ট্রিস্ট্যাকনা মনেস্ট্রিমাথো মনেস্ট্রিএদের সবাই মধ্যে আমার সবথেকে ভালো লাগলো ঠিকসে মনেস্ট্রিঠিকসে এর উপর থেকে সামনের উপত্যকার দৃশ্য অভূতপূর্ণ.ঘুরতে ঘুরত 3 idioits  দেখানো লাদাখের স্কুল টিও দেখে নিলামএরপর আমরা ইন্ডাস নদীর ধারে একটি ফাঁকা জায়গা দেখে লাঞ্চ টা সেরে নিলামলাদাখের ভূদৃশ্য কে যেন প্রতি মুহূর্তে নতুন করে খুঁজে পাওয়া যায়. প্রতিটি মুহূর্তই সে যেন অসাধারণলাঞ্চ সেরে আমরা এগিয়ে গেলাম ম্যাগনেটিক হিল এর দিকেএই জায়গাটি শ্রীনগর হাইওয়ের উপরে অবস্থিতগাড়িথেকে নেমে যখন আমরা ম্যাগনেটিক হিল এর সৌন্দর্য উপভোগ করছিআমাদের ড্রাইভার বোঝালো কেন জায়গাটার নাম ম্যাগনেটিক হিলচুম্বকার্শিত পদার্থরা এই পাহাড়ের দিকে অনায়াসেই আকর্ষিত হয়ে এগিয়ে চলে.এই পরিস্থিতি টা practically বোঝানোর জন্য আমাদের ড্রাইভার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে গাড়িটিকে ওই পাহাড়ের দিকে মুখ করে রাখলেন. আমরা আশ্চর্যান্বিত হয়ে দেখলাম গাড়িটি স্বতঃফূর্ত ভাবে মাধ্যাকর্ষণকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চললোতারপর দেখলাম অনেকেই আমাদের মতো ওই জায়গায় এসে গাড়িবন্ধ করে প্রকৃতির এই অদ্ভুত আচরণকে উপভোগ করছে .এরপর আমরা লে এর দিকে ফিরে আসছিলামহঠাৎ আমাদের ড্রাইভার দেখালেনরাস্তার ধারে যে মাটি কাটা হচ্ছে সেটি নাকিমুলতানি মাটিব্যাসমুলতানি মাটির নাম শুনে অনেকেই গাড়ি থেকে নেমে প্যাকেট করে কিছু মাটি তুলে নিলোআর  ৩০ মিনিট যাত্রার পরে আমরা হোটেলে পৌঁছে গেলামরাতেএকবার লে বাজারটাও ঘুরে দেখে নিলামআগামীকাল থেকে আমাদের আসল ঘোরা শুরু - গন্তব্যস্থল নুব্রা ভ্যালি.


Nubra valley


সকাল সকাল উঠে ব্রেকফাস্ট সেরেই তৈরী হয়ে গেলাম নুব্রা ভযালি যাওয়ার জন্যআজ আমরা আরো একটি কারণে আবেগকম্পিতকারণ আজ আমরা পৃথিবীর সর্বোচ্চ মোটরগাড়িচলার রাস্তা দিয়ে যাবো - খারদুংলা পাস(১৮,৩৮০ ফুট)সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেকটা উঁচু হবার জন্য অক্সিজেন এর মাত্রা এখানে ১০%. তাই লে ছাড়ার আগে ২টি অক্সিজেন এর সিলিন্ডারকিনে রাখলামচড়াই রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে  ঘন্টায় আমরা খারদুংলা পৌঁছে গেসিলামচারদিকে শুধু সাদা বরফ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে নাঅল্প অল্প তুষারপাত তখনওহচ্ছিলোতাই আমরা গাড়ি থেকে নেমে একটু তুষারপাত উপভোগ করে নিলামঅক্সিজেনের মাত্রা কম থাকার জন্য আমাদের একটু কষ্ট হচ্ছিলো তাই আমরা এগিয়ে চললাম নুব্রাভ্যালির দিকেসায়ক নদীর পার দিয়ে চলতে চলতে আরও ৩ঘন্টা পর আমরা গিয়ে পৌঁছলাম নুব্রা ভ্যালিপ্রথমে আমরা সমস্যানলিং গুমফা তে গিয়ে আমাদের লাঞ্চটা সেরে নিলাম.তারপর গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম হুন্ডারেহুন্ডার এক অদ্ভুত জায়গা যেখানে সবুজ গাছমরুভূমি আর তুষারে ঢাকা পাহাড় একসাথে দেখা যায়হোটেলে মালপত্তর রেখে চলে গেলামমরুভূমির দিকেএই মরুভূমিতে এক বিশেষ প্রকারের ব্যাকটেরিয়াল উটের সওয়ারী হয়আমাদের মধ্যে কিছু লোক গেলো সেই সওয়ারী নিতেআমি ক্যামেরা নিয়ে এগিযে গেলামপ্রকৃতির এই অদ্ভুত বৈপরীত্বকে ক্যামেরা বন্দি করার জন্যআমার জানার মধ্যে হুন্ডার হয়তো একমাত্র জায়গা যেখানে মরুভূমি গিয়ে শেষ হয়েছে বরফে ঢাকা পাহাড়েসন্ধ্যে পর্যন্তমরুভূমিতে কাটিয়ে আমরা লামিজিং গেস্ট হাউসে ফিরে আসলামআমাদের জন্য সুন্দর বন-ফায়ার এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং সাথে সাথে সারা রাতব্যাপি আমাদের গান বাজনাওচললোনুব্রা ভ্যালির উচ্চতা লে এর থেকে একটু কম বলে হয়তো এখানে তেমন শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো না বা হয়তো এখানকার জলবায়ুর সাথে আমাদের শরীর কিছুটা অভ্যস্তই হয়ে পড়েছে. আগুনের পাশে বসে আমরা সবাই মিলে রাতের খাবার টা সেরে ঘুমের রাজ্যে ঢোলে পড়লাম. পরের দিন সকাল সকাল উঠে চারিপাশটা একটু ঘুরে আসলামব্রেকফাস্ট সেরে আমরাআবার লে যাবার পথে এগিয়ে চললামফেরার সময়ে ডিস্কিট মনেস্ট্রি  দেখে নিলামডিস্কিট মনেস্ট্রি হলো নুব্রা ভ্যালির সব থেকে বড়ো বুদ্ধিস্ট মনেস্ট্রিএর সামনে ৩২ মিটারের উঁচুমৈত্রেয়ী বুদ্ধের এক অভূতপূর্ণ স্থাপত্য বিরাজ করছে. এখান থেকে নুব্রা ভ্যালির প্যানোরামিক সৌন্দর্য সত্যিই হাতে আঁকা ছবির মতো মনে হয়ফেরার সময়ে খারদুংলা পাসে তুষারপাতহচ্ছে না বলে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সেই শ্বেতশুভ্র রূপ উপভোগ করলাম. ওখানে  কিছু ভিনদেশি পর্যটকের সাথে আলাপ হলো আমাদের যারা সাইকেল নিয়ে নুব্রা ভ্যালি যাচ্ছে.ওনাদের সাথে কথা বলে,ওনাদের দক্ষতার কথা স্মরণ করে সত্যিই মন ভোরে যায় আর নিজেদের মধ্যে দুঃসাহসিক অভিযান এর স্পীহা বেড়ে যায়.এখানে বেশিক্ষন কাটালেই মাথাধরতে শুরু করে , তাই আমরা আর বেশি দেরি না করে লে তে চলে আসলামআজ সন্ধ্যে বেলা তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম.

Pangong Lake

First light of the day near Pangong


পরের দিন আমাদের গন্তব্যস্থল হলো প্যাংগং সরোবরএটি সেই প্যাংগং সরোবর যেখানে শাহরুখ খানআমির  খান দের সিনেমায় দেখেছিলাদাখে প্যাংগং সরোবরই পর্যটকদের শ্রেষ্ঠআকর্ষণপ্যাংগং সরোবরের (১৪,২৭০ ফুট৪০অংশ ভারতে এবং ৬০চিনেলবনাক্ত হ্রদ হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু শীত কালে পুরো সরোবরটি বরফে রূপান্তরিত হয়ে যায়সকাল ৮টানাগাদ আমারদের গাড়ি চলে আসলো  আমরা ইন্দাস নদীর পার ধরে এগিয়ে চললাম হেমিসের দিকেহেমিসে এসে আমরা আমাদের ব্রেকফাস্টও করে নিলামএবার কিছু নিরাপত্তাপরীক্ষা করে আমরা এগিয়ে চললাম ছাঙলা পাস (১৭,৫৯০ ফুটএর দিকেছাঙলা পাস পৌঁছতে পৌঁছতে আর  ২ঘন্টা লেগে গেলোখারদুংলা পাস এর মতন এখানেও অক্সিজেনেরমাত্রা খুব কম বলে বেশিক্ষন ছাঙলা পাসে না কাটিয়ে সামনে এগিয়ে চললামহেমিস থেকে প্যাংগংয়ের পথে অনেক পর্যটকের সাথে দেখা হলো আমাদেরকেউ দিল্লীকেউ কলকাতা,কেউ বা বেঙ্গালুরু থেকে বাইক নিয়ে এসেছেপুরো রাস্তা জুড়ে ধূসর পাহাড়ের উপর মেঘ  রোদের খেলা দেখতে দেখতেই সময়ে কেটে গেলোমাঝে মধ্যেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রকৃতিরএই সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দি করে নিলামএকটি জলাধারের পাশে এসে আমাদের ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করালেনএখানে নাকি মার্মাট নামক এক প্রকার প্রাণী মাটির নিচেই বসবাস করে.তারা পর্যটকে দের থেকে খাবার পাবার লোভে রাস্তার ধারে এসে দাঁড়িয়ে থাকেআমরা গাড়ি থেকে নেমেই দেখলাম অনেক মার্মাট একটি মাঠে ছুটে বেড়াচ্ছেআমাদের কৌতূহল বেড়েগেলো . মার্মাটগুলোকে কাছ থেকে দেখার জন্য আমরা সামনে এগিয়ে গেলামছোট্ট প্রাণীগুলোকে সামনে থেকে দেখতে ভীষণ অবাক লাগছিলোকারণ ওদের আচরণ দেখে মনেহচ্ছিলো ওরা আমাদের বহুবছর ধরে চেনেবিস্কুটের লোভে পারলে আমাদের কোলে উঠে আসেআর দেরি না করে আমরা এগিয়ে চললাম প্যাংগংয়ের দিকেদুপুর ১টা নাগাদ আমরালক্ষ করলাম ধূসর পাহাড়ের মধ্য দিয়ে একটি নীল হ্রদ উঁকি মারছেসবাই বুঝতে পারলাম যে আমরা আমাদের গন্তব্যস্তলে পৌঁছে গেছিআর ৩০মিনিটের মধ্যেই আমরা প্যাংগংসরোবরের ধারে পৌঁছে গেলামসত্যিই যেন প্রকৃতির ক্যানভাসে ভগবানের রঙ্গিন তুলি টানরুক্ষ পাহাড়ের বুকে এমন নীল রঙের সরোবরের মোহময় রূপ সবাইকে যেন বাকরুদ্ধ করেদেয়সরোবরের ধরেই আমাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা করা ছিললাঞ্চ করে সরোবরের ধার দিয়েই আমরা এগিয়ে চললাম স্প্যাংমিকের দিকেওখানেই আজ আমাদের টেন্টের ব্যবস্থা করেহয়েছেটেন্টে পৌঁছানোর পর হঠাৎ বৃষ্টি হবার জন্য সবার একটু মন খারাপ হলেও ৩০ মিনিটের মধ্যেই আবার ঝকঝকে রোদ্দুর সবার মন ভরিয়ে দিলোসময় নষ্ট না করে ক্যামেরানিয়ে হাটতে হাটতে প্যাংগং সরোবরের ধারে চলে গেলামস্প্যাংমিক একটি ছোট গ্রামের মতোকিছু স্থানীয় বাসিন্দাকে চাষবাস করতেও দেখা গেলোসরোবরের উপর আলো ছায়ারলুকোচুরি ক্যামেরাবন্দি করে নিলাম বাকি জীবনের স্মৃতির জন্যসূর্যের শেষ কিরণ পর্যন্ত আমরা সরোবরের পাশে বসেই কাটালামসূর্যাস্তের পর তেমন কিছু করার থাকেনা বলে আমরাটেন্টে ফিরে আসলামবাইরে ভীষণ হাওয়া বইলেওটেন্টের ভিতরে অপেক্ষাকৃত আরামদায়ককফির কাপে চুমুক দিয়ে সবাই মিলে আড্ডা মেরে কাটালামরাত ৮টা নাগাদ ডিনারকরতে টেন্ট থেকে বেরিয়ে দেখলাম সারা আকাশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ তারা ঝিকিমিকিজীবনে প্রথমবার নিজের চোখে আকাশগঙ্গা দেখে বিস্মিত হয়ে গেলামডিনার সেরে তাড়াতাড়ি শুয়েপড়লাম কারণ পরেরদিন সকালের সূর্যোদয় দেখার অভিজ্ঞতাটা ছাড়া যাবে নাপরেরদিন সূর্যোদয়ের আগেই ঘুম থেকে উঠে দেখলামআমাদের টেন্টের উপর বরফের একটা পাতলাআস্তরণ পরে গেছেটেন্টের সামনেই চা এর কাপে মুখ দিয়ে সকালের সূর্যোদয় উপভোগ করলাম সবাই মিলেএবার ফেরার পালাব্রেকফাস্ট করে প্যাংগংয়ের মোহ ছাড়ার আগেশেষবারের মতন দেখে নিলাম প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্যকেশেষবারের মতন প্যাংগং সরোবরকে দেখে সবার মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেছিলোআগের দিনের রাস্তা দিয়েই প্রকৃতির এইঅপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে সন্ধ্যের মধ্যে আমরা লে পৌঁছে গেলাম


Tso-Moriri Lake


লাদাখে এসে সো মোরিরি না দেখে গেলে লাদাখ যাত্রা কখনোই সম্পূর্ণ হয় নাসো মোরিরি লাদাখ থেকে 200 কিমি দক্ষিণে এবং উচ্ছতায় (14836 ft) - প্যাংগং সরোবর থেকে কিছুটাবেশিসো মোরিরি লাদাখের উচ্চতম সরোবরএই সরোবর সম্পর্কে খুব বেশি না জানলেওইন্টারনেটে যেটুকু পড়েছি তাতে আমি সো মোরিরি দেখার জন্য সব চেয়ে বেশি আগ্রহীছিলামএই দিন আমরা সকাল 7 টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লামআমাদের ড্রাইভার বললো আজকের রাস্তা সব থেকে দীর্ঘতম এবং সব থেকে সুন্দরলে থেকে বেরিয়েই আমরা ইন্দাসনদীকে ডান রেখে এগিয়ে চললামপুরো রাস্তাতে ইন্দাস নদী আমাদের অনুসরণ করছেএগোতে এগোতে কখন জানি ধূসর পাহাড় গুলো গোলাপি রঙের হয়ে গেছে বুঝতেই পারলাম না.আবার কখনো নীলচেকখনো বা সবুজপাহাড়ের এতো রকম রং দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়এখন বুঝলাম কেন পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ বাইক নিয়ে মানালিথেকে লে আসেএই ঐশ্বারিক সৌন্দর্যকে যেন কোনোভাবেই চোখের আড়াল হতে দেওয়া যায়নাপ্রায় 4 ঘন্টা পর আমরা পৌঁছলাম চুমথাংএখানে এবার আমাদের ইন্দাস নদীকেবিদায়ে জানানোর পালাকিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে এবং কিছু খেয়ে আমরা এগিয়ে চললাম সো মোরিরির দিকেকিছুক্ষন পর দূরে একটা সরোবর দেখে উৎসাহিত হয়ে আমরা আমাদেরড্রাইভার কে জিজ্ঞাসা করলামআমরা কি পৌঁছে গেছি ? উনি বললেন এটি হলো কায়াগার সরোবরসত্যিই এই জীবনে এতো সুন্দর জায়গা আমি দেখিনিচারিদিকে ধূসর পাহাড়েরউপর সবুজ আভাএকটু দূরে বরফের পাহাড়ের শৃঙ্গ এবং মাঝে একটি শান্ত নীল হ্রদহ্রদ এর পশে কিছু তিব্বতি গাধা চড়ে বেড়াচ্ছেমনে হচ্ছিলো এখানেই টেন্ট বানিয়ে থেকে যাই,কিন্তু আমাদের বুকিং আছে সো মোরিরি তে তাই এগিয়ে চললামআর 30 মিনিটের মধ্যেই সো মোরিরির চেকপোস্ট  পৌঁছে গেলামসো মোরিরির পাশে কার্জক নামে একটি ছোটগ্রামসেখানেই আজ রাত্রে থাকার ব্যবস্থা করেছিলামএখানকার লোকেরা সো মোরিরির তীরে চাষবাস করে জীবনযাপন করেনএখানকার সৌন্দর্য যা ভেবেছিলাম তার থেকে বহুগুনবেশিসামনে সবুজহলুদলাল রঙের ক্ষেতএরপর নীল হ্রদ আর ওপারে ধূসর পাহাড় এবং তার উপর দিকে বরফভারত তো দূরের কথাআমি স্বপ্নেও কখোনো কল্পনা করিনি যেপৃথিবী তে এতো সুন্দর জায়গা বিদ্যমানকিছুক্ষন বিশ্রাম নেবার পর আমাদের ড্রাইভার সো মোরিরির সামনের দিকে নিয়ে গেলোসেখান থেকে কর্জক গ্রামটির সৌন্দর্য অভূতপূর্ণকিন্তুআজ প্রকৃতি আমাদের সাথে ছিল নাহঠাৎ বৃষ্টি আসার জন্য আজকের মতন আমরা হোটেল  ফিরে গেলামলম্বা জার্নির জন্য আজ আমরা সবাই খুব ক্লান্ততাই তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়েপড়লামপরের দিন ভোর হবার আগেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ক্ষেতের ভিতর দিয়েদূরে বরফে ঢাকা পাহাড়ের পিছন দিয়ে সূর্যোদয় অভূতপূর্ণআস্তে আস্তে সূর্যের আলো গ্রামএর উপর এসে পড়ায় বেশ আরামই লাগছিলোবিভিন্ন রকমের গবাদি পশুরা চারিদিকে চড়ে বেড়াচ্ছেগ্রামের ছোট থেকে বড় সবাই চাষবাস করতে চলে আসে এই ক্ষেতেকিছুক্ষনসরোবর তীরে কাটিয়ে হোটেলে ফিরে আসলাম বিস্ময়কর প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য দেখেব্রেকফাস্ট খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম লে দিকেফেরার সময়ে প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ দেখতেদেখতে ঠিক করলামএখানে আবার ফিরে আসতেই হবে


Tso-Moriri


লে তে ফিরে আসতে আসতে আবহাওয়া একটু খারাপ হয়ে গেছিলোহোটেল পৌঁছতে পৌঁছতে জোর বৃষ্টিও শুরু হয়ে যায়পরের দিন সকালই ফ্লাইট বলে একটু ভয়ই লাগছিলোব্যাগগুছিয়ে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম সেদিনের মতনপরেরদিন সকালেও আবহাওয়া এতটুকুও ঠিক হলো নাএয়ারপোর্ট- গিয়ে জানলাম আজকের সব ফ্লাইট বাতিলহয়তোলাদাখ কে বড্ড বেশিই ভালোবেসে ফেলেছিতাই ভগবানও চায় একদিন বেশি থেকে যাইযাইহোকআবার হোটেলে ফিরে এসে পরের দিনের ফ্লাইটে আমরা দিল্লী চলে আসলামদিল্লীথেকে বিকালের ফ্লাইটে কলকাতা

No comments:

Post a Comment